।। শান্তির জায়গা শান্তিপুর।।
"সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে"- কথাটা নদিয়ার শান্তিপুরে না গেলে বোধ হয় বুঝতে পারতাম না।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে শান্তিপুর লোকালে উঠেছি । সঙ্গে আছে প্রতীম । দীর্ঘ পথ। ট্রেনে মোট ২.৩০ ঘন্টা সময় লাগে। প্রচন্ড ভিড় হয় এই ট্রেনে। একটা অদ্ভুত কিন্তু খুব সুন্দর নিয়ম আছে শান্তিপুরগামী লোকাল ট্রেন গুলোতে ----আপনি বসার সিট পেলেও , অর্ধেক পথ কিন্তু আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের বসার সুযোগ করে দিতে হবে। অর্থাৎ আপনাকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
যাইহোক Proteem Basak এর বাড়িতে আস্তানা নিলাম । প্রতীমের মা'র অতিথি আপ্যায়নের কোনো তুলনা হয় না, কাকিমার লক্ষ্মীশ্রী চেহারা , ও মিষ্টি ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে তুলেছিলো। গোটা পরিবারই বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। খুব ভালো লাগলো ওর ছোট ভাইকে--- নাম #রুপম । একটু লাজুক স্বভাবের । ক্লাস সেভেনে পড়ে।
জিজ্ঞাসা করলাম- "কোন স্কুল?"
ও বললো "মুসলিম স্কুল"। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কি শুধু মুসলিমরা পড়ে?"।
ও আমাকে বললো- "ওখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই পড়ে।"
প্রতীম আমাকে বললো--- এখানে হিন্দু স্কুলও আছে। সেখানে হিন্দু- মুসলিম সবাই পড়াশোনা করে। আরো অনেক কিছু ভালো লেগেছিলো, সে কথা পরে একদিন বলবো। "বিভেদের মাঝে দেখো , মিলনও মহান"- এটাই শান্তিপুর।।
নিজের চোখে দেখলাম শান্তিপুরবাসী খুব পরিশ্রমী ও কর্মঠ হয়, ঘরে ঘরে পেশা বলতে তাঁত শিল্প । সকালে ঘুম ভাঙলো #খট_খট আওয়াজ শুনে। প্রতীমকে জিঞ্জাসা করলাম--"ওটা কিসের শব্দ শোনা যাচ্ছে"। ও বললো-- "তাঁতের মেশিনের শব্দ। লোডসেডিং তাই কাঠের মেশিনে শাড়ি বুনছেন আনেকে ।আমাদের এখানে বেশীরভাগ লোকেই ইলেকট্রিক মেশিনে তাঁত বোনে"।
দারুণ তো! জেদ ধরলাম, কিভাবে শাড়ি তৈরি হয় দেখবো।
পরেরদিন দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। প্রথমে #গঙ্গা_দর্শন। প্রতীমের বাইকে করে ওর আদুরে আদুরে গলায় এলাকার বর্ণনা শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত দক্ষিণের খেয়া ঘাটে।
কবির ভাষায় " শান্তিপুরের দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া গঙ্গার যেরুপ শোভা এমন আর কোথায় আছে!"
সত্যিই না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। দীর্ঘ গঙ্গা। ঘাটেতে মায়েরা , লোকেরা, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা স্নান করছেন। ঘাটের সামনে বিশ্রামাগার। আর ঘাটের একপাশে অনেকগুলি নৌকা বাঁধা আছে। গঙ্গার মাঝখানের চড়া পড়ে যাওয়া অংশে কাশফুলের সারি। গঙ্গার পাড় গুলিতে প্রশস্ত বনরাশি আর সবুজ বনের মাঝে সাদা থোকো থোকো কাশ ফুল। এক অপরুপ শোভা।
এরপর গেলাম শান্তিপুরে মহাশ্মশান দর্শন করতে। কথিত আছে গঙ্গার দক্ষিণ প্রান্তের শ্বশান স্বর্গের দ্বার। পৌরাণিক কাল থেকেই এটা পূণ্যস্থান বলে মনে করা হয়। কাঠের চুল্লির পাশাপাশি দেখলাম আধুনিক ইলেকট্রিক চুল্লিও আছে। মনটা কেমন হু হু করে উঠলো। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলাম না।
এরপর গেলাম মহাপুরুষ চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্যর সাধনপীঠ নিকটবর্তী #বাবলা_গ্রামে।চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ও অদ্বৈতাচার্যের মিলন ঘটেছিল এই বাবলায়। সন্ন্যাস গ্রহণের পর এখানেই চৈতন্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শচীমায়ের।
মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই অনুভব করলাম একটা অকল্পনীয় শান্তি ও নিরবতা। ভিতরে অনেকগুলি মন্দির , ছায়া ঘেরা গোটা এলাকা। গাছের তলায় এখানে সেখানে়, মন্দিরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন ভক্তরা। খুব সুন্দর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। একটা গাছেতে আটকানো ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা আছে ....."পাদুকা যুগলকে এই স্থানে বিশ্রাম দিন।"😀
এরপর ইষ্ট দেবতাকে প্রণাম করে ওখান থেকে ফিরে আসার পথে রাস্তার ধারে ধারে দেখলাম তাঁতিরা; বাঁশের ফ্রেমে নতুন বোনা কাপড়ে মাড় দিয়ে শুকোতে দিয়েছেন। ছবি তোলার ইচ্ছা থাকলেও তুলতে পারলাম না। কারণ অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে। যাইহোক ওর বাড়ি ফিরে দ্বিপ্রহরের আহার সেরে একটু বিশ্রাম নিলাম।
এরপর সন্ধ্যাবেলা আবার এলাকা ঘুরতে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম Saowni Das এর বাড়ি , ওর বাড়িতে সবার সাথে দারুণ ভাবে গল্পের আসর বসে গেলো। সবাই খুব ভালো । খুব বন্ধুত্বপূর্ণ । ওদের গোটা বাড়ি ঘুরে দেখলাম। সন্ধ্যা বেলা লুচি আর মাংস কব্জি ডুবিয়ে খেলাম।
তারপর ঘুরতে ঘুরতে প্রতীম আমাকে দেখালো কোথায় মিঠুন চক্রবর্তীর বাড়ি! আর দেখলাম কুমোর পাড়ার দূর্গা প্রতিমা গড়ার দৃশ্য। মাটির সোঁদা গন্ধ, আর বাতাসে একটা একটা #মা #মা ভাব । খুব উপভোগ করলাম মুহূর্তটা।
আবার চলে আসলাম প্রতীমের বাড়ি । রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে অফিসের কিছু পেন্ডিং কাজ সারতে সারতে ৩টে বেজে গেলো। শুয়ে পড়লাম ।
ঘুম ভাঙলো বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের গান শুনে -------------- "যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ ||"
দেবীপক্ষে ভোরের শান্তিপুর।। চোখ মুখ ধুয়ে মোবাইল নিয়ে শান্তিপুরের মনমুগ্ধকর কিছু ছবি তুললাম। এবার ঘরে ফেরার পালা । মা আসছেন। #বিদায়_শান্তিপুর । বন্ধুরা আপনারাও পারলে একবার ঘুরে আসুন শান্তিপুর। আমার খুব ভালো লেগেছিলো, আশা করি আপনাদেরও খুব ভালো লাগবে।